আনিসুর রহমান এরশাদ

নিজের ভবিষ্যৎ নিজেকেই গড়তে হবে

কোনো শিক্ষার্থীকে যদি প্রশ্ন করা হয় তোমার জীবনের লক্ষ্য কী বা তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? অনেকে বলবে ডাক্তার হতে চাই, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, পাইলট হতে চাই, বিসিএস ক্যাডার হতে চাই, ব্যাংকার হতে চাই ইত্যদি। অথচ কেউ বলবে না ভালো মানুষ হতে চাই, ভালো মুসলমান হতে চাই।
এই যে জীবিকা অর্জনের একটা উপলক্ষ্যকে জীবনের লক্ষ্য বানানো এতে মানুষ খুব ছোট হয়ে যায়। পেশার সাথে সম্মানের কিছু নাই। পেশার কারণে কেউ সম্মানিত বা অসম্মানিত হতে পারে না। ভালো মানুষ হওয়াকে যদি ১ ধরা হয় বাকি একেকটির জন্য ডানে এক এক করে শূণ্য বসে বড় সংখ্যা হয়, জীবনটা মূল্যবান হয়। কিন্তু পদ-পদবী-ক্ষমতা ক্যারিয়ার যাই হোক, ভালো মানুষ না হলে এসবের জন্য যা পাওয়া তা অর্থহীন শূন্য মাত্র!

সব মানুষকে সম্মানের চোখে দেখতে হবে। সকল পেশাকে সম্মানের চোখে দেখতে হবে। হোক সে গৃহকর্মী, গাড়ির ড্রাইভার, বাসার দারোয়ান কিংবা অফিসের পিয়ন; তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে। কারো বাবা-মা যদি কায়িক পরিশ্রমও করে তার জন্য গর্বিত হওয়া যাবে না, লজ্জিত হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে- সম্মান আসে জ্ঞান, চরিত্র, সততা, পরোপকারিতা, ভালো ব্যবহার, মহানুভবতা থেকে; যার অর্থ-সম্পদ বেশি, বিত্ত-বৈভব বেশি সেই সম্মান পাওয়ার বেশি উপযুক্ত নয়।

প্রতিটি কাজকে সম্মান করবেন। যে কাজ নিজে করতে পারেন সে কাজের জন্যে অন্য কারো ওপরে নির্ভর করবেন না। কাজে লজ্জা নেই। লজ্জা অলসতায়। লজ্জা প্রতারণায়। লজ্জা কর্মহীনতায়। হযরত আদম (আ.) চাষ করতেন, কৃষিকাজ করতেন। হযরত হাওয়া (আ.) সুতা কাটতেন। হযরত ইদ্রিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও লুত (আ.) কৃষক ছিলেন। হযরত সালিহ (আ.) ছিলেন ব্যবসায়ী।
হযরত মুসা (আ.) এক দশক ধরে শোয়াইব (আ.) এর অধীনস্থ হাউজকীপার ছিলেন। রাখালের কাজও করতেন। হযরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন রাখাল। হযরত ইউসুফ (আ.) গৃহপরিচারকের কাজ করতেন, ডমেস্টিক ওয়ার্কার ছিলেন। হযরত নূহ (আ.) নৌকা নির্মাতা শ্রমিক ছিলেন, কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। হযরত দাউদ (আ.) কর্মকার ছিলেন, ঢাল-তরবারী-বর্ম তৈরি করতেন। নিজ হাতের কামাই খেতেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) রাখালও ছিলেন। বালতি দিয়ে কূপ থেকে পানি তুলে খেজুর বাগানে পানি দিতেন। নিজে মেষচারণ করেছেন, কাপড় সেলাই করেছেন, ঘর ঝাড়ু দিয়েছেন, রান্নার কাজও করতেন। হযরত খাদিজার (রা.) সহকারী হিসেবে বাণিজ্য করেছেন। ইমাম আবু হানিফার দাদা ছিলেন একজন ক্রীতদাস।
কাঠুরিয়ার ছেলে আর মুদি দোকানদার হয়েও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন আব্রাহাম লিংকন। হোয়াইট হাউসে গিয়েও প্রেসিডেন্ট লিংকন নিজের জুতো নিজেই পালিশ করতেন। বস্তির ছেলে নোংরা পোশাকের কারণে যে পাবলিক পার্কে প্রবেশ করতে পারেননি, সেই এন্ড্রু কার্নেগীই তা কিনে নিয়েছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো নদীর পাড়ে সস্তা ভাড়ার বস্তিতে তাকতেন। গরিব পরিবারের এই সন্তান প্রেসিডেন্ট হয়েও দামি পোশাক পরেন না, পায়ে দেন না দামি জুতা। স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ চৌধুরী শুরুতে নিজের অফিসের দারোয়ান, ঝাড়ুদার, কেরানির সব কাজ নিজ হাতেই করতেন। গামছা পেতে দোকানে দোকানে তোলা চাঁদায় ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান।

আপনার ভাগ্য আপনাকেই গড়তে হবে। আপনার বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন তোমার ক্যারিয়ার গড়ে দিতে পারবে না। আপনার অতীত যাই থাকুক থাক, বর্তমানকে কাজে লাগান, ভবিষ্যতে ভালো করবেন। ইতালির সাবেক প্রেসিডেন্ট মুসোলিনি মুচির কাজ করেছেন। জার্মানির সাবেক প্রেসিডেন্ট এডলফ হিটলার মেথরের কাজ করেছেন। মিসরের বাদশা ফেরাউন কবর খানায় কাজ করেছেন। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এ. পি. জে আবদুল কালাম পত্রিকার হকার ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন খেয়াঘাটের মাঝি ছিলেন। হান্ডুরাসের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট জেয়লা মুরগী চোর ছিলেন। লিবিয়ার নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফীর এক পা ছিল না তবু জনপ্রিয়তা ছিল। শ্রীলংকার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকে কুমারাতুঙ্গার একচোখ অন্ধ ছিল বলেতো ক্ষমতা কম ছিল না। প্রথম দিকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন।
পরিশ্রম করতে হবে। মহানবী সা. ৫৫ বছর বয়সেও রমজান মাসে ৭০ মাইল পাহাড়ী রাস্তা হেঁটে বদর যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।বিজয়ের জন্য ১৫ বছর ধ্যান করেছেন, ১৩ বছর ধৈর্য ধরে দাওয়াত দিয়েছেন, ১০ বছর সংগ্রাম চালিয়েছেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ইবাদতে কাটাতেন। ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মাণের সময়ও সবার সাথে মাটি কাটায় অংশ নিয়েছেন, মাটি বহন করেছেন।

হযরত আবু বকর (রা.) খলিফা হবার পরও কাপড়ের বোঝা মাথায় করে বিক্রির জন্য বাজারে যেতেন। হযরত ওমর (রা.) খলিফা থাকাকালে গরীবদের ঘরে গম এবং খেজুরের বোঝা মাথায় করে নিয়ে যেতেন। হযরত আলী (রা.) খলিফা হয়েও মুসাফিরের বোঝা বহনকারী কুলি হতে লজ্জা পাননি। ইমাম বুখারী রহ. একটি হাদীস সংগ্রহে ৩০০ মাইল হেঁটেছেন।

চীনের মাও সেতুং সর্বপ্রকার কায়িক পরিশ্রম করতেন। টমাস আলভা এডিসন দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করেছেন। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৫বার পরাজয়ের পর মাকড়সা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্কটল্যান্ডের রবার্ট ব্রুস ৬ষ্ঠবারে জয়লাভ করেছিলেন। ১০০০ নতুন বিষয়ের আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন ২ বছরে ১০ হাজার বার ব্যর্থ চেষ্টা করে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালতে পেরেছিলেন। আমেরিকার সেরা ধনী জন.ডি.রকফেলার ঘন্টায় ৪ সেন্টের বিনিময়ে আলুক্ষেতে কাঠফাটা রোদে কোদাল দিয়ে কাজ করেছেন।

এখনই শুরু করতে হবে। মহানবী সা. সমাজ সংস্কারে হিলফুল-ফযুল গড়েছিলেন ১৭ বছর বয়সে। আলী রা. রাসূলের সঙ্গী হয়েছিলেন ১১ বছর বয়সে। নেপোলিয়ান ইতালি জয় করেছিলেন ২৫ বছর বয়সে। আইনস্টাইন আপেক্ষিক মতবাদ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন ১৬ বছরে, প্রমাণ করেছিলেন ২৬ বছরে। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর ১১ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন। হুমায়ুন ২৩ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন। সম্রাট আকবর ১৩ বছর বয়সে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন।
এদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৪ বছর বয়সে ভাষণ দিয়ে জাদরেল বক্তাদেরকেও মাত করে দিয়েছিলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ৭ম শ্রেণিতে পড়াকালিন ভারতবর্ষব্যাপী চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ১ম হয়েছিলেন। ড. আবদুল্লাহ আল মুতি ১৮ বছর বয়সে কিশোর পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন।

অতীত থেকে বর্তমানে প্রেরণা নিয়ে ভবিষ্যতকে গড়তে হবে। মুসলিম উম্মাহ হিসেবে প্রেরণা নেয়ার কত কিছুই তো আছে। কর্ডোভাতে পৃথিবীর ১ম বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানরা স্থাপন করেন। যখন ইউরোপে খ্রিস্টানদের বড় লাইব্রেরিতে বই ছিল ২০১টি, তখন কায়রোতে মুসলমানদের পাঠাগারে ছিল ১০ লাখ বই।
কাগজ, ঘড়ি, বারুদ, মানচিত্র, ইউরোপ থেকে ভারতের রাস্তা এমনকি আমেরিকার আবিষ্কর্তা মুসলমানেরা। আল খারিজমী ছিলেন আজকের বীজগণিতের জনক। আল-কিন্দী দর্শনের প্রথম পরিচায়ক ও ভাষ্যকার। বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড এর পথ প্রদর্শক। খালিদ বিন অলিদ, তারেক বিন যিয়াদ, স্পেন বিজয়ী মুসা, মুহাম্মদ বিন কাসিম, বখতিয়ার খিলজী আমাদের অনুপ্রেরণা।

বাংলাদেশী হিসেবেও আমাদের গর্ব করার মতো আছে অনেক কিছুই। বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কুমিল্লার ময়নামতির শালবন বিহার। আমেরিকা যখন গোসল শিখেনি, তারও আগে আমরা সাবান ব্যবহার করতে শিখেছি। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের সভ্যতা ও স্বাধীনতার ইতিহাস।
আমাদের এফ. আর. খান বিশ্বের সর্বোচ্চ দালানের স্থপতি। আমাদের গর্ব ঈসা খাঁ, তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ। শাহজালাল, মাহ মখদুম, খানজাহান আমাদের প্রেরণা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের স্বাধনীতা যুদ্ধ আমাদের গৌরবের।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বের অবদান অনস্বীকার্য।

সময়কে কাজে লাগাতে হবে। সোহরাওয়ার্দি কমোডে বসেই পত্রিকা পড়া শেষ করতেন। কোষ্ঠকাঠিন্য থাকায় সময় বেশি লাগতো। শেখ সাদী ঘুমে স্বপ্নে পেয়েছিলেন ‘সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’। শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান হচ্ছে- ভালো বই পড়বেন, ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থাকবেন, ভালো শিক্ষকের গাইডলাইন নিবেন আর বাবা-মায়ের দোয়া পাবার উপযুক্ত আচার-ব্যবহার করবেন; অবশ্যই আপনি বড় হবেন, ভালো মানুষ হবেন।

জিটিএফসি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জিনজিরা ক্যাম্পাসের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন লেখক ও সাংবাদিক আনিসুর রহমান এরশাদ।  বক্তব্যটি লিখিতভাবে এখানে তুলে ধরা হলো।

Leave a Reply