সন্তানের স্বপ্নে ‘আশকারা’ দিন

সন্তানের স্বপ্নে ‘আশকারা’ দিন

মাধ্যমিক শেণিতে পড়ার সময় রচনা লিখতে হতো। এইম ইন লাইফ। এখনো বোধহয় সব শিক্ষার্থীকে এই রচনা লিখতে হয়।

আমি গ্রামের স্কুলের ছাত্র ছিলাম। কাদাপানি মাড়িয়ে স্কুলে ঢোকার পর স্বপ্ন হয়ে যেত ডাক্তার হওয়ার। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।

এই স্বপ্ন আমি কিংবা আমার সহপাঠিরা স্ব-ইচ্ছায় কখনো দেখিনি। বাবা-মা, স্কুলের শিক্ষকদের ইচ্ছাই হয়ে যেত আমাদের স্বপ্ন। আমাদের এইম ইন লাইফ।

স্কুলে পাঠানোর আগে মা যখন মাথার চুল আঁচড়ে দিতেন, তখন কানের কাছে মন্ত্রও জপে দিতেন— আমার ছেলে বড় হয়ে বিরাট ডাক্তার হবে।

এক পা দু-পা ফেলে গ্রামের কাঁচা রাস্তা পেরোনোর সময় নিজেকে ডাক্তার ভেবে এগোতাম। আশেপাশে তাকাতাম— কোনো রোগী দেখা যায় কিনা।

ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে হবে। পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, রসায়ন এবং ম্যাথমেটিক্স এর মারপ্যাঁচ বুঝতে হবে।
স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের স্যাররা মোটা বেত নিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকতেন। সেটা নাচাতে নাচাতে বলতেন— এই সূত্রগুলো মুখস্ত করে ফেলতে হবে। একেবারে ভাজা ভাজা করে। ঠোঁটের আগায় যেন চলে আসে।

আমরা কেরোসিন পুড়িয়ে আলো জ্বালাতাম। হারিকেন। কেরোসিন পোড়ানো গন্ধে নিউটনের গতিসূত্র ভাজা ভাজা করে পরদিন স্কুলে যেতাম। স্যারের মোটা বেতের নাচানাচির সামনে প্রায়শই সূত্রগুলো ঠোঁটের আগায় আসতো না। ফলাফল— বেদম বেত্রাঘাত।

স্কুল থেকে ফেরার পথে পিঠে বেত্রাঘাতের বেদনা নিয়ে ভাবতাম— আমার কি তাহলে ডাক্তার হওয়া হবে না? কিংবা ইঞ্জিনিয়ার?

মন ভেঙে যেত। মন উদাস হতো। সেই উদাস মন নিয়ে লিখে ফেলতাম কবিতা। মনে মনে হয়ে উঠতাম— কবি।

এক সময় লক্ষ্য করলাম আমার ম্যাথমেটিক্সের খাতায় অংকের সমাধানের বদলে কবিতার চরণ জায়গা করে নিয়েছে বেশি। পদার্থ বিজ্ঞানের খাতায় নিউটনের গতিসূত্রের পাশেই ছোট ছোট গল্প লিখে ফেলেছি। এসব কবিতা-গল্প লিখতে আমাকে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। কোনো কিছু মুখস্ত করার তাড়া নেই। ভালো না লাগলেও পড়তে হবে— এমন কোনো চাপ নেই।

আমি বুঝে ফেললাম— ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার মধ্যে নেই।

তাহলে আমার এইম ইন লাইফ কী?

আমি জানতাম না। বাবা-মা নিশ্চিত, আমি একজন সফল ডাক্তার হিসেবে জীবন শেষ করব। স্কুলের শিক্ষকরাও ভাবেন, এই ছেলে ডাক্তর-ইঞ্জিনিয়ার, কিছু একটা তো হবেই। স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে।

অথচ ততোদিনে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার শখ মিটে গেছে। ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে আমি কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না। আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে। দুহাত খুলে গল্প লিখতে ইচ্ছে করছে। আমার মাথার মধ্যে কিলবিল করছে নানা রকম গল্প-কবিতার প্লট।

প্রাণীর টিকে থাকার ব্যাপারে চার্লস ডারউইন কী গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব বলেছেন তার চেয়ে বেশি আগ্রহ পাচ্ছি আমার পাঠ্যপুস্তকে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘রসগোল্লা‘ গল্প পড়ে। গল্প পড়ে বিমল আনন্দ পাচ্ছি। গল্পের প্রতিটিা শব্দ, বর্ণ আমার মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলছে। আমি চোখের সামনে দেখছি— তাগড়া শরীরের ঝান্ডু দা বাকশো থেকে রসগোল্লা বের করে লেপটে দিচ্ছেন ইমিগ্রেশন অফিসারের মুখে।

বলা বাহুল্য, আমার গল্প লেখার ইচ্ছা দিন দিন বাড়ছে।

এটাও বলা বাহুল্য, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কসরত বাদ দিয়ে গল্প-কবিতা নিয়ে ভাবছি, এ কথা জানতে পারলে আমার বাবা-মা কিংবা শিক্ষক— কেউই আস্ত রাখবেন না। নিউটনের সূত্রের মতো আমাকে ভাজা ভাজা করে ফেলবেন।

এর পরের গল্পটা বেশ বিষাদের। আমার বুকের মধ্যে লেখক হওয়ার স্বপ্ন। অন্যদিকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে বাবা-মা’র স্বপ্ন পূরণের জন্য। একটা সময় এসে লক্ষ্য করলাম— আমার কোনোটাই হওয়া হলো না। আমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলাম না। কারণ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি, ইচ্ছা থাকা দরকার— তা আমার মধ্যে নেই। অন্যদিকে গল্প-কবিতা লেখার জন্য যেভাবে সময় ব্যয় করা উচিত, পড়াশোনা করা উচিত— তাও করতে পারিনি। সবশেষে আমি হয়ে পড়েছি এক দ্বিধান্বিত মানুষ।

দ্বিধান্বিত মানুষ সফলতা পায় না, যতক্ষণ না তার দ্বিধা কাটছে।

আশি-নব্বইয়ের দশকে বেড়ে ওঠা আমার মতো গ্রামের ছেলে-মেয়েদের নিজের ‘এইম ইন লাইফ’ বলে তেমন কিছু ছিল না। শহরের ছেলে-মেয়েদেরও যে খুব একটা ছিল, তাও না। তবু শহুরে শিক্ষার্থীরা হয়তো আরেকটু স্বাধীনতা ভোগ করেছে।

তবে এখন সময় বদলেছে। এখনকার অভিভাবকেরা অনেক সচেতন। তারা জানেন, সন্তানের এইম ইন লাইফ সন্তানকেই ঠিক করতে দেওয়া উচিত। মুশকিল হলো, উচিত জেনেও অভিভাবকেরা সন্তানের ওপর অনেক কিছুই চাপিয়ে দেন। অনেক সময় মায়ের অধরা স্বপ্ন মেয়েকে দিয়ে মেটাতে চান। কিংবা বাবার হাত ফস্কে যাওয়া স্বপ্ন ছেলেকে দিয়ে পূরণ করতে চান।

একজন মানুষকে সফল হতে হলে যে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে— এমন কোনো কথা নেই। আপনার সন্তান তখনই সফল হবে, সফলতার শীর্ষে উঠতে পারবে, যখন তার স্বপ্নের কাজটি তাকে করতে দেওয়া হবে। হয়তো আপনার সন্তান ফিল্ম মেকার হতে চায়। আঁকিয়ে হতে চায়। কৃষিবিদ হতে চায়। দূর সমুদ্রের নাবিক হতে চায়। ফুটবলার হতে চায়। কিংবা কবি হতে চায়।

আপনি এসবের কিছু জানেন না বলেই তাকে অন্য কিছু হতে উৎসাহিত করছেন। তার বুকের স্বপ্নকে দুমড়ে ফেলছেন শুরুতেই।

ভালো হয়, অভিভাবকেরা যদি সন্তানের বুকে কান পাতেন। বোঝার চেষ্টা করেন, তার সন্তানের স্বপ্নটাকে। ভালো হয় সেই স্বপ্নে যদি তারা ‘আশকারা’ দেন।

সন্তানের আগ্রহের বিষয়বস্তুকে যদি গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন, সব অভিভাবকই টের পাবেন। বাবা-মায়ের চেয়ে সন্তানকে আর কে ভালো চিনতে পারে?

তুমুল প্রতিভাবান সন্তানও কর্মজীবনে এসে হোঁচট খায়। তখন অভিভাবকেরাও ধাক্কা খান। তারা আফসোস করেন— আমার এতো প্রতিভাববান সন্তানটা সফল হতে পারলো না।

অথচ প্রতিটি সন্তানের ভবিষ্যত সফলতা লুকিয়ে থাকে তার শৈশবে, কৈশরে। তাকে অঙ্কুরোদগমের দায়িত্ব অভিভাবককেই পালন করতে হয়।

সোহেল অটল : সাংবাদিক ও লেখক

Leave a Reply